অর্থবহ স্বাধীনতা

স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায় ?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।।

কোটি কল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,
নরকের প্রায়।
দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ-সুখ তায় হে,
স্বর্গ-সুখ তায়।।

সার্থক জীবন আর বাহু-বল তার হে,
বাহু-বল তার।
আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে,
দেশের উদ্ধার।।

অতএব রণভূমে চল ত্বরা যাই হে,
চল ত্বরা যাই।
দেশহিতে মরে যেই, তুল্য তার নাই হে,
তুল্য তার নাই।।

‘স্বাধীনতা-হীনতায়’ – রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়
স্বাধীনতা ! কী এক মধুর শব্দ, অন্তরে রিনিকি-ঝিনিকি সুর তোলে। কিন্তু স্বাধীনতার সঠিক অর্থ আমাদের অনেকের কাছেই সম্পূর্ণ বোধগম্য নয়। ও হ্যাঁ, আমরা সবাই জানি, স্বাধীনতার বিপরীত শব্দটা হচ্ছে পরাধীনতা। পরাধীনতা মানে অপরের অধীন। তা’হলে অপরের অধীনের বিপরীতার্থক শব্দগুচ্ছ অবশ্যই ‘নিজের অধীন’। সুতরাং অপরের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের অধীনতা মেনে নেওয়ার নামই হচ্ছে স্বাধীনতা।

‘নিজের অধীন’ কথাটা কারও কারও কাছে একটু হাস্যকর মনে হতে পারে। তা’হলে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। নিজের অধীনতা হলো নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা। নিজের, দেশের, দশের, আপামর জনগণের কল্যাণে যে নিয়ম, যে আইন প্রণীত হয়ে থাকে, সে সবের অধীনে নিজেকে সমর্পণ করতে পারলেই কেবল কোন একজন মানুষ নিজের স্বাধীনতা  নিশ্চিত হয়েছে বলে দাবী করতে পারেন।
এই ছোট্ট আলোচনা থেকে আমরা অতি ক্ষুদ্র ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। আর সেটা হচ্ছে, স্বাধীনতার অর্থ স্বেচ্ছাচারিতা নয়। অথচ প্রায়ই আমরা এই ভুলটা করে থাকি। আমি স্বাধীন, আমরা স্বাধীন – আমার যা ইচ্ছে তা করার অধিকার আমার আছে। এ যে কত বড় ভুল বিভ্রান্তি, তা অনুধাবন করতে না-পারা কারোর জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

আমরা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের দেশটা স্বাধীন, সার্বভৌম। দেশের নাগরিকগণকে নিয়ন্ত্রণের সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রের উপরে ন্যস্ত। রাষ্ট্রকে সে ক্ষমতা দিয়েছে এ দেশের জনগণ। তা’হলে দেশটা স্বাধীন হলেও আমরা, দেশের জনগণ স্বেচ্ছায় সে দেশের উপরে আমাদের নিয়ন্ত্রণের ভার অর্পণ করেছি, অর্থাৎ দেশের আইন-কানুন-নিয়ম-বিধির পরাধীনতা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছি।  স্বাধীন দেশের নাগরিক হলেও স্বেচ্ছাচার হবার সকল সুযোগ আমরা হারিয়েছি স্বেচ্ছায়।

কোন একটা দেশের স্বাধীনতার প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে একটা জাতি, একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, নিজস্ব শাসনব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সার্বভৌমত্ব। জাতি ছিল, ভূখণ্ড ছিল, কিন্তু শাসনব্যবস্থা আর সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আমাদের এই দেশ ছিল অপরের কুক্ষিগত। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শোষণ করতে শুরু করে দেশের এ অঞ্চলকে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ঢাকায় অসংখ্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ এবং ইপিআর সদস্যদের নির্বিচারে হত্যা করে ।

পাকিস্তানীদের পরিকল্পিত এই গণহত্যার উপযুক্ত জবাব দিতে সারাদেশে শুরু হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। জীবন রক্ষার্থে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষের সমন্বয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী সারাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এক পর্যায়ে ভারতে বিমান হামলা চালালে ভারত  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত হয়ে হতোদ্যম পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর’৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তিরানব্বই হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এরই মাধ্যমে নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালী জাতির স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ আচরণে এদেশের মানুষ ছিল কোণঠাঁসা, তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের জবাবে ২৫ মার্চ রাতের কাপুরুষোচিত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬শে মার্চের ঊষালগ্নে ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই সে দিনটিই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মানুষের লোভ-লালসা আর স্বেচ্ছাচারিতা দেশের উন্নয়নের অন্তরায়। তাদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ হয়ে উঠেছে স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বার্থপরতা। যথাযথ শিক্ষা আর মানসিক উন্নয়নই পারে এদেরকে দমন করে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ জনগণের দ্বারে পৌঁছে দিতে।

প্রথমে যে কথাগুলো বলা হয়েছে সেগুলো শুধু মনে রাখলেই চলবে না, বিশ্বাস করতে হবে – মেনে চলতে হবে। যা ইচ্ছা তা করা নয় দেশের আইন-কানুন, নিয়ম-বিধি মেনে যার যার দায়িত্ব পালন করাই হচ্ছে দেশের প্রতি সকল নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। মুখে মুখে দেশকে ভালোবাসি বললে, গালভরা শ্লোগান দিলে, দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে হুঙ্কার তুললে দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করা হয় না। তিনিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক, যিনি মনপ্রাণ দিয়ে তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করেন। দেশপ্রেম মানুষের একটি স্বভাবজাত গুণ।  যে ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং বড় হয় ওঠে, সেই পরিবেশের প্রতি, সেখানকার মানুষের প্রতি তার একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ ও দায়বদ্ধতা গড়ে ওঠে। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি এ আজন্ম আকর্ষণই দেশপ্রেম।  লাখো মানুষের আত্মত্যাগে অর্জিত এ স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে প্রতিটা মুহূর্ত নিজেকে উজাড় করে দেবার প্রতিজ্ঞায় নিজেকে আবদ্ধ করতে হবে। শুধু নিজের স্বার্থ নয়, বিবেচনায় রাখতে হবে দেশের স্বার্থকে সব কিছুর ঊর্দ্ধে।
[নাজমুল হুদা (সাবেক উপসচিব)]
দখিনা ৫২তম সংখ্যায় প্রকাশিত

 

About নাজমুল হুদা

আমার যত লেখা শুধুই লেখার জন্য! এতে না আছে আত্মতুষ্টি, না আছে কারো মনোরঞ্জনের সম্ভাবনা!! আমার এ সব আবর্জনা ঘেটে কেউ শিক্ষণীয় কিছু পাবে কিনা তা নিয়ে আমার নিজেরই আছে প্রবল সন্দেহ। তবু লিখি, লিখে যাই মনের খেয়ালে। কেউ যদি পড়ে একটুও আনন্দ পায়, তা হবে আমার পরম পাওয়া।

2 responses to “অর্থবহ স্বাধীনতা”

  1. Ashim Bhowmick says :

    অশেষ কৃতজ্ঞতা, স্যার।

আপনার মতামত দিন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

শব্দপুঞ্জ

কখনো স্ফুলিঙ্গ, কখনো বরফকুচি ...

মাহমুদুল হাসান ফেরদৌস এর কালির আঁচড়

জড়ো হ‌ওয়া শব্দের অভয়াশ্রম

অগ্নিপথ

সত্য সমাদ্ধৃত, মিথ্যা অপসৃত

গোধূলি লগনে

রাঙ্গিয়া উঠিলে তুমি কাহারে দেখিয়া

আলাউল হক সৌরভ'এর ব্লগ

একজন সৌরভ, তেমন কেউ না, অতি সাধারণদের মাঝে শুধুই একজন অসাধারণ...

ভোরের ব্লগ-বাঁধনের মুক্তআকাশ

সারা দিনের খোলা বাতায়ন...

কঙ্কণের রিনিঝিনি

হাসি খুশী আনন্দ অমলিন স্নেহ সাথী হোক সকলের সকল সময়

সুরঞ্জনার ব্লগ

সুরঞ্জনার ব্লগ

রুমান'স ব্লগ

যেখানে পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ সম বিস্তৃত

ঝলক

নাজমুল হুদার ব্লগ নানাবিধ বিষয়ে এই ব্লগ সমৃদ্ধ। এর মাঝে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপরে জোর দেওয়া হবে।

মঙ্গলধ্বনি

প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের পক্ষে

নৈঃশাব্দিক

নিঃশব্দ বাস্তব

সাপ্তাহিক ব্যবচ্ছেদ

সংবাদ ও বিশ্লষণ

লুব্ধক

ইচ্ছেপূরণের খড়কুটো কুড়াতে এসো শিল্প বিনির্মাণে অনন্য হই সৃষ্টিসুখের পরিশুদ্ধ উল্লাসে.......

অর্ণব আর্কের খেরোখাতা

ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নতত্ত্ব আর রাজনীতি

অগ্নিপথ

সত্য সমাদ্ধৃত, মিথ্যা অপসৃত

পথহারা পথিক

আঁধারের পথে হেঁটে চলা এক পথিক। আলোর খোঁজে ছুটছি নিরুদ্দেশ......