পানি নিয়ে ভাবনা
পানি নিয়ে ভাবনা তো আছেই, কিন্তু ক’জনে আর ভাবে তেমন করে। এই যে বছর বছর বন্যা হয়, সাইক্লোন আসে (কখনও আইলা, কখনও মহাসেন, ইত্যাদি) সাথে নিয়ে আসে আট/দশ ফুট পানির পাহাড়। ঢল নামে পাহাড়ে, ধসে পড়ে পাহাড়। পানির জন্যই তো এত সব বিপত্তি। পানির এই সব ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক দিক নিয়ে ভাবনা বড় একটা কম তো হয় না। তবু বলি, তেমন করে আর ভাবে কয়জনেইবা!
জ্যোতির্বিজ্ঞানী তার দূরবীনে চোখ রেখে মহাবিশ্বের কোথায় কোন নক্ষত্র, তা দেখেন, তা নিয়ে ভাবেন। কিন্তু তার ভাবনার মাঝে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও যে ভাবনাটা প্রাধান্য পায় তা হলো কোন নক্ষত্রে আছে পানি, আছে অক্সিজেন। প্রকারান্তরে তার এই ভাবনার প্রধান কারণ, পানি আর অক্সিজেন থাকলেই শুধু সেখানে এই পৃথিবীর মত বা অন্য কোন রকম হলেও জীব সেখানে পাওয়া যাবে। পৃথিবীর এই যে বর্তমান রূপ, অপরূপ সজ্জা, বৈচিত্রময় পরিবেশ সব কিছুর পিছনে আছে পানি। এই পানিতেই জন্ম নিয়েছে আদিপ্রাণ, আজকের এই জীবজগত। পানির মত এমন গুণ আর কিছুতেই নেই, কোন কিছুর সাথেই পানির এই ক্ষমতার তুলনা করা যায় না।
আবারও বলি, পানি নিয়ে যারা এমন করে ভাবে তাদের সংখ্যা কিন্তু অতি নগন্য। আর তার কারণ মোটেও অবোধ্য নয়। আমাদের চারপাশে এত বেশী পানি আমরা প্রতিনিয়ত দেখি যে, এর মাঝে কোন বিশেষত্ব থাকতে পারে তা আমাদের মাথায়ই আসে না। আমরা এও জানি যে, ভূপৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগই চাপা পড়ে আছে পানির নীচে। এ ছাড়া ভূপৃষ্ঠের এক-পঞ্চমাংশ জমাট বাঁধা পানিতে (বরফ) ঢেকে আছে। পৃথিবীর অর্ধেকটারও বেশী অংশ তো সব সময় বাষ্পীভূত পানির কণা দিয়ে তৈরী মেঘের আবরনে আবৃত থাকে। আর যেখানে মেঘ থাকে না, সেখানে যত অল্পই হোক থাকে জলীয় বাষ্প। পানির এই যে প্রাচুর্য আর আধিপত্য তা জীবদেহেও লক্ষ্য করা যায়। আমাদের, মানুষের শরীরের শতকরা ৭১ ভাগই পানি। এই যে চারদিকে, সব কিছুতে পানির এত আধিক্য, এরই ফলে পানির মাঝে বিস্ময়কর কিছু খুঁজতে আর চায় না কেউ। সর্বত্র পানির এত ছড়াছড়ি, এত সহজলভ্যতা, আকাশ-বাতাস-মর্ত্য, সকল জীবদেহ সবখানে এমন প্রাচুর্য তাও কিন্তু কম বিস্ময় নয়। পৃথিবীর আর কোন পদার্থ এমন ভাবে সব কিছুতে বিরাজ করে এমন তথ্য জানা নেই কারো। আবার একই সময়ে কঠিন, তরল ও বাষ্পীয় অবস্থাতেও পানি ভিন্ন অন্য পদার্থের অস্তিত্ব জানা যায় না।
পৃথিবী ও এর আবহাওয়া যে এমন সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে তার কৃতিত্বও পানির। পানি যদি না থাকতো এই সাধের দুনিয়া ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধা একটা গ্রহে পরিণত হতো, জীবজগত বলে কোন কিছুই থাকতো না, প্রাণের সঞ্চারই ঘটতো না। কেন? পানির বৈশিষ্ট এই যে, এটা তাপে দ্রুত গরম না হয়ে ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে এবং প্রচুর তাপ ধারণ করে রাখতে পারে। আবার ঠাণ্ডা হবার সময় তা অতি ধীরে তাপকে মুক্ত করতে থাকে। পৃথিবী নামের এই গ্রহের সকল সাগর-মহাসাগর-হ্রদ, ছোট বড় সকল জলাশয়, এমন কি বাতাসে ভাসমান জলকণা সব কিছুই সূর্যের তাপ ধারণ বা সঞ্চয় করে রাখতে সক্ষম। সূর্যালোক যখন থাকে না, তখন এই সঞ্চিত তাপ মুক্ত হতে থাকে ধীরে ধীরে। আর এভাবেই পৃথিবীর উষ্ণতা বজায় থাকে, আবহাওয়া কখনোই সহনশীলতার সীমা অতিক্রম করে না।
আমরা জানি, মহাশূন্য শীতল থেকেও শীতলতর। মহাশূন্যের এই শীতলতা আমাদের এই গ্রহকে গ্রাস করতে পারে না, এমন কি সে শীতলতার প্রভাবে প্রভাবান্বিতও করতে পারে না। আর এ জন্য একক ভূমিকা পানিরই। এ গ্রহের চতুষ্পার্শ্ব ঘিরে রয়েছে জলীয় বাষ্পের এক অদৃশ্য স্তর, যাকে আমাদের পশমের কম্বলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। জলীয় বাষ্পের এই কম্বল মহাশূন্যের হিম শীতলতাকে যেমন পৃথিবীর দিকে আসতে বাধা দেয়, তেমনই পৃথিবীর (পানির) ধারণ করে রাখা তাপ মহাশূন্যে মিলিয়ে যাবার সুযোগ দেয় না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। মরুভূমিতে দিনের বেলায় প্রচণ্ড গরম, আবার রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা, এ কথা সকলেরই জানা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, মরু এলাকায় জলীয় বাষ্পের স্বল্পতা বা অভাব। সামান্য পরিমানে যে জলীয় বাষ্প মরু অঞ্চলের অদৃশ্য বাষ্পীয় কম্বল গঠন করে, তাতেও থাকে হাজারো ছিদ্র। সে কারণে সূর্যের তাপ প্রায় বিনা বাধায় মরুপৃষ্ঠকে তাতিয়ে তোলে, আবার একই কারণে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই তাপ হারাতে থাকে। ফলে নির্বিঘ্নে বেড়ে যায় মরুভূমির শীতলতা।
পানির আর একটা বৈশিষ্ট সম্পর্কেও আমাদের জানা আছে। পানি থাকলেও পানির এই বৈশিষ্ট যদি না থাকতো তা’হলে এই গ্রহটি হতো একেবারে নিরেট বরফের গ্রহ। পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থ ঠাণ্ডায় সঙ্কুচিত হয়, তাপে সম্প্রসারিত হয়। একমাত্র পানিই এর ব্যতিক্রম। অন্যান্য পদার্থের মত পানিও ঠাণ্ডায় সঙ্কুচিত হলে কি ঘটতে পারতো তা দেখা যাক। সঙ্কুচিত পানির (বরফের) ওজন যেত বেড়ে, উপরের স্তরের পানি জমে তার ওজনের কারণে তলিয়ে যেত। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে অচিরেই জমাট পানি (বরফ) ছাড়া পানির আর কোন অস্তিত্বই থাকতো না। পৃথিবী হয়ে যেত একখণ্ড বরফ, যাকে ঘিরে থাকতো কোন জলীয় বাষ্পবিহীন গ্যাসীয় একটা স্তর।
অসমাপ্ত … …।
[বাকী অংশ নিয়ে পরে কোন একসময় আবার আলাপ করা যাবে।]
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ